Powered By Blogger

মানুষ,মেয়ে মানুষ,ছেলে মানুষ

একদম ছোটবেলা থেকে কম্বাইন্ড স্কুলে পড়াশুনা করেছি।খেলার সময় ছেলে মেয়েরা একসাথে ছোয়াছুয়ি খেলেছি।ক্লাস রুমের একপাশে ছেলেরা,এক পাশে মেয়েরা বসত।মাঝে মধ্যে দুই শিবিরের মধ্যে ঝগড়াও হত!সেই কেজি থেকে কলেজ পর্যন্ত একসাথে পড়াশুনা করে এসেছি।ছোট থাকতে বুঝিনি কিন্তু এখন বুঝি আমি অনেক বেশি ভাগ্যবান কারণ আমি কম্বাইন্ড স্কুলে পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছি।কিশোর বয়সে যখন বিপরীত লিঙ্গের প্রতি স্বাভাবিক এবং সহজাত আকর্ষন জন্ম নেয় সেই সময়টাতেও মেয়ে বন্ধু,মেয়ে সহপাঠিদের সান্নিধ্যে ছিলাম।কৈশরের বৈশিষ্ট্য থেকে হয়তো কারো কারো প্রতি ভাললাগাও তৈরি হয়েছিল যাদের সাথে এখন দেখা হলে,”আরে দোস্ত কি খবর?” বলে চিৎকার করে উঠতে পারি!কম্বাইন্ডে পড়ায় আমার লাভ কি হয়েছে?
আমার ফেসবুকে দেয়া ছবি গুলো যারা দেখেন তারা নিশ্চই জানেন আমার বন্ধুদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যাধিক্য।আমার মনে হয় “বন্ধু”র কোন লিংগ পরিচয় থাকেনা।বন্ধু সেই যার সাথে আমার চিন্তা চেতনার মিল থাকবে,বন্ধু সে যে আমার দুঃসময়ে আমাকে আকড়ে ধরে রাখবে-সে ছেলে নাকি মেয়ে এটাকি খুব গুরুত্বপূর্ণ?আমার মনে হয়,না।বিদায় বেলায় কিংবা প্রবল আনন্দে অথবা দুঃখে যেভাবে আমি আমার একটা ছেলে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরতে পারি তেমনি একটা মেয়ে বন্ধুকেও পারি,সে সময় আমার মধ্যে তীব্র বন্ধুত্বের আবেগ কাজ করে,কোন “আকর্ষন” বা “শারীরিক অনুভূতি” কাজ করেনা।
গ্রামগঞ্জের অনেক ছেলেদের সাথে আমি মিশেছি,আর আমি নিজে তো শহুরে ছেলে।একটা জিনিস নিশ্চিত ভাবে বলতে পারি “নারী শরীর” নিয়ে রসালো আলাপ গ্রামগঞ্জের ছেলেদের আড্ডায় বেশি হয়।কেন বলতে পারেন?ওরা আধুনিক শিক্ষা পায়না বলে?না,ব্যাপারটা আসলে সেটা নয়।গ্রামে কিংবা মফস্বলে ছেলে-মেয়েদের মেশার সুযোগ অনেক কম।ফলে যে বয়সে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষন এবং আগ্রহ জন্ম নেয় সেই বয়সে তারা জানতে পারেনা কিছুই।জানতে পারেনা প্রাকৃতিক পরিবর্তন গুলোর কথা যেগুলো খুব স্বাভাবিক ভাবে অতীত থেকে হয়ে আসছে,ভবিষ্যতেও হবে।যে পরিবর্তন গুলোর মধ্য দিয়ে নবি-রাসূল দেরও যেতে হয়েছিল,সাধারন সব মানুষদেরও যেতে হয়।ফলে তাদের কাছে মেয়ে মানেই একটা “কিছু”।একটা মেয়ে যে তার মতই মানুষ এটা সে খুব কমই চিন্তা করে।ফলে “নারী শরির” নিয়ে রসালো আলাপ করেই সে কৌতূহল মেটায়।একটা রহস্য থেকে যায় তার মনে।
আর এগুলোর ফলাফল হল ইভটিজিং,ধর্ষন,যৌন হয়রানির মত বিষয় গুলো।যারা বয়েজ স্কুল কলেজে পড়েছেন তাদের আমি ছোট করছিনা,তাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা পূর্বক বলছি-বয়েজ স্কুল কলেজে পড়া ছেলেদের মধ্যেও এই প্রবণতা কাজ করে।ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বোঝাপড়া আর সহজ সম্পর্ক গড়ে ওঠেনা বলেই একদিকে যেমন স্বাভাবিক ভাবে সহবস্থান করা সম্ভব হয়না অপরদিকে অস্বাভাবিক ভাবে সৃষ্টি হয় ইভ টিজিং এর মত সামাজিক ব্যাধি।এখনও আমাদের দেশে একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে একসাথে রিকশায় দেখলে অনেকেই বাকা চোখে তাকায়।আর এরকম মানসিকতা থেকেই মনে হয় পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের জন্ম নেয়।
আমাদের গল্প,উপন্যাস কিংবা সিনেমা নাটকে,এমনকি কার্টুন গুলোতেও মেয়েদের কে এমন একটা দুর্বল অবস্থানে দেখানো হয় যেখানে সে বিপদে পড়লে তাকে উদ্ধার করতে আসে কোন নায়ক।এমনকি সিনেমার নায়িকা যদি পুলিশ অফিসারও হয় সেখানেও তাকে দুর্বল হিসেবেই উপস্থাপন করা হয় যেখানে মাস্তান নায়কের সাহায্যেই তাকে ভিলেনের হাত থেকে উদ্ধার পেতে হয়।নিজের বিরত্ব দিয়ে না,নাচ গান করে তাকে ভিলেনের ডেরা থেকে আক্রান্ত দের উদ্ধার করতে হয়।
ধর্ষন বা বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক হলে নারী তার “সতীত্ব” হারায় কিন্তু পুরুষের কিছু হয়না।কোন প্রেমিক-প্রেমিকার মধ্যে যদি বিয়ের আগে যৌন সম্পর্ক হয় তাহলে প্রেমিকার ভার্জিনিটি নষ্ট হয়,প্রেমিক এর ভার্জিনিটি কি নষ্ট হয় না??কিন্তু দায়ভার যেন সব মেয়েটিরই।যে ছেলে এমন অসংখ্য প্রেমিকার ভার্জিনিটি “নষ্ট” করে সেই বিয়ে করার সময় “সতী” মেয়ে খোজ করে।বিয়ের পর যদি সে জানতে পারে তার স্ত্রীও কোন এক সময় তারই মত কোন এক প্রেমিকের প্রেমিকা ছিল তখন সে কি করবে?তখন সে নিজের কৃতকর্মের কথা বিস্মৃত হয়ে মেয়েটির প্রতিই দোষারোপ করবে।
আমাদের সমাজে এখনও ধর্ষিতাকে নিজের পরিচয় গোপন রেখে লজ্জা আর গঞ্জনায় দিন কাটাতে হয় আর ধর্ষক নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়ায়।ব্যাপারটা থেকে মনে হয় ধর্ষিতার সব দোষ।কিন্তু এই অদ্ভূত আচরন কেন?যে ধর্ষিতা তার যোনি তে কোন পুরুষের পুরুষাংগ প্রবেশ করল বলে সে অসতী?আর যে পশুটি এই কাজ করল তার কোন দোষ নেই?লজ্জা তো হওয়া উচিত ধর্ষকের,সামাজিক গঞ্জনা তো সওয়া উচিত ধর্ষকের কিন্তু কেন উলটোটা হচ্ছে?নারী অপবিত্র এমন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কারণে?আমাকে একবার কে যেন বলেছিল,তুমি বিয়ে করবে কোন ধর্ষিতাকে?আজব প্রশ্ন।একজন মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে বলে তাকে আমি করুনা করে বিয়ে করতে যাব কেন?তবে প্রশ্নটি যদি এমন হয় তোমার প্রেমিকা ধর্ষিতা হলে তাকে বিয়ে করতে?তাহলে উত্তর অবশ্যই,হ্যা।৭১ এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অসংখ্য ধর্ষিতা নারিদের তাদের পরিবার,স্বামি দূরে থাক-পিতা মাতাও ঘরে তুলে নেয়নি,সামাজিক অমর্যাদার ভয়ে!এই সমাজ কে আমি ঘৃনা করি,ধিক্কার দেই।
ধর্ম আমাকে শিক্ষা দিচ্ছে আমার পাজড়ের হাড় থেকে আমার স্ত্রী সৃষ্টি হয়েছে,অতএব তার উপর আমার পূর্ণ কর্তৃত্ব,পূর্ণ অধিকার! ( ছোট বেলায় যখন এটা প্রথম জেনেছিলাম তখন মনে প্রশ্ন জেগেছিল,যে পুরুষ ৩-৪ টা বিয়ে করে তার পাজড়ের হাড় থাকারই তো কথা না,আর যে পুরুষ বিয়ে করেনা তার পাজড়ের হাড়ে তৈরি স্ত্রী কোথায় গেল?কিংবা যে মহিলা একধিক বিয়ে করেন তিনি কি দুজন পুরুষের পাজড় থেকে সৃষ্ট?)এই সব যুক্তি ব্যবহার করে মেয়েদের দমিয়ে রাখার প্রবনতা আদিকাল থেকেই চলে আসছে।আমাদের সমাজেও তাই তৈরি হয়েছে নানা রকম নিয়ম কানুন।যেসব নিয়মের জন্য ছেলে মেয়েদের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে উঠছেনা।আর তার বিকৃত প্রকাশ ঘটছে নানা রকম অন্যায়ের মাধ্যমে।
কাল দেখলাম একজন স্ট্যাটাস দিয়েছেন,যার মূল বক্তব্য হল মেয়েরা যদি বুকের উপর ওড়না না দেয় তাহলে তার যৌনানুভূতি তো জাগবেই।এই ক্ষেত্রে ধর্ষন হলে মেয়েটিও সমান ভাবে দোষী!কি অদ্ভূত যুক্তি।আচ্ছা তাহলে ৫ বছরের শিশু ধর্ষিত হয় কেন?আমি কমেন্ট করেছিলাম “আপনার মা কি সারাদিন বাসায় ওড়না পড়ে থাকেন?” সেই ব্যক্তি আমার প্রশ্নের জবাব দেননি,নগদে ব্লক করে দিয়েছেন।ভালই হল,আমিই দিতাম।আমার আগে সে নিজে থেকেই বের হয়ে গেছে।
একজন স্বাবলম্বি মেয়ে যিনি কিনা অর্থনৈতিক ভাবে পরনির্ভরশীল নন,তিনিও কি পূর্ণ স্বাধিনতা ভোগ করেন?আমার মনে হয় না।পুরুষের ইচ্ছা অনিচ্ছা তার স্বাধিনতা নিয়ন্ত্রন করে বলে আমার মনে হয়।একজন নারী যদি মনে করেন তিনি বিবাহিত জীবনে সুখী নন,সেক্ষেত্রে কি করা উচিত বলে আপনার মনে হয়?কষ্ট সহ্য করে নাক মুখ বুজে পড়ে থাকা উচিত নাকি বেড়িয়ে আসা উচিত?আমাদের সমাজ বলছে তুমি চুপ করে কষ্ট সহ্য কর কারণ তুমি মেয়ে!অনেকটা সিনেমার ডায়ালগের মত “মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছ তখন তো কষ্ট সহ্য করতেই হবে!”… কিন্তু স্বাভাবিক নিয়ম হওয়া উচিত কষ্ট ছেড়ে বেড়িয়ে আসার নিয়ম।কিন্তু সেটা করার মত সাহস কজন মেয়ে করতে পারছে?
আমি একজন মানুষ।মেয়ে দেখলেই যাদের যৌনঅনুভূতিতে সুড়সুড়ি লাগে তারা কেবলি পুরুষ,মানুষ না।একজন ছেলে হিসেবে আমি চাই আমি যে যে সুযোগ সুবিধা গুলো ভোগ করি ঠিক সেই সেই সুযোগ গুলো আমার বোনও ভোগ করুক।আমি যেভাবে চিন্তা করি,যেই স্বাধিনতা ভোগ করি আমার বোনও সেই স্বাধিনতা গুলো পাক।মেয়েরা দুর্বল,তাদের রক্ষাকর্তা হিসেবে একজন পুরুষ অবশ্যই লাগবে এই মানসিকতা ত্যাগ না করলে সম-অধিকার জিনিসটা আসলে এক ধরনের প্রহসন।
অনেক ছেলেই আছে যারা মেয়েদের সাথে কথা বলতে গেলে নার্ভাস হয়ে যায়।এটাও কিন্তু মেয়েদের মানুষ মনে না করে “কিছু” একটা কিংবা মেয়ে মানুষ মনে করার ফল।এই সব সমস্যার সহজ সমাধান একটাই,যেদিন থেকে আপনি পাশের মেয়েটিকে আপনার মতই মানুষ ভাববেন সেদিন থেকে আপনার পক্ষে কোন মেয়েকে অপমান করাও সম্ভব হবেনা,আপনার যৌনানুভূতিও জাগবেনা।বাসে একটা মেয়ের সাথে গায়ে গা লাগলে কোন অনুভূতি হয়?মেয়েটিকে মেয়ে না ভেবে মানুষ ভাবুন দেখবেন কিছুই মনে হচ্ছেনা।
আমি জানি অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে,খুব ধীরে ধীরে…কিন্তু হচ্ছে তো!মেয়েরা পুরুষের চেয়ে কম মর্যাদা সম্পন্ন এই ধারনা ত্যাগ করলেই অনেক কিছু সমাধান হয়ে যেত।কিন্তু আফসোস,আমরা সেটা কতটুকু করছি?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন