Powered By Blogger

একটি সস্তা প্রেমের গল্প

রওশন সাহেব মহা ব্যস্ত।তার একমাত্র মেয়ে চৈতি কে দেখতে আসবে ছেলে পক্ষ।ছেলে ভালই,একটা কলেজে শিক্ষকতা করে।মাত্র পড়াশুনা শেষ করেছে।

মেয়ের মতামত না নিয়েই কথাবার্তা বলে ফেলেছেন।মেয়ের কোন পছন্দ থাকতে পারে।সে ব্যাপারে কথা বলা উচিত ছিল কিন্তু তিনি ঠিক ভরসা পাননি।এখন মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হয়নি।এখন আর কিছু করার নেই।ছেলে পক্ষ রাজি হলে মেয়েকে এখানেই বিয়ে দেবেন।এমন ছেলে হাত ছাড়া করা ঠিক হবেনা।মেয়ের মুখে তিনি অনিচ্ছা আর চাপা বিরক্তির আভাস পেয়েছেন।অবশ্য সেটাকে তিনি আমলে নেননি।

চৈতিকে চা-নাস্তা হাতে ছেলে পক্ষের সামনে নিয়ে আসা হল।ছেলের নাম জাহিদ।চৈতিকে একনজর দেখল সে।বাড়ি গিয়ে মেয়ে দেখার এই বিষয়টা জাহিদের ঠিক পছন্দ না।এযুগে সে চল নেই।কিন্তু কে বুঝাবে তা মাকে।জাহিদের বাবা মারা গেছেন অনেক আগেই।মা ই সব।
জাহিদের মা জাহানারা বেগম চৈতির সাথে নানা রকম কথা বলছিলেন।জাহিদ চুপচাপ বসে ছিল আনমনা হয়ে।মায়ের ডাকে সম্বিত ফিরে পেল।
"কিরে তুই চুপ কেন?কথা বল।সংসার তো তুই ই করবি।"

মায়ের মুখে এখন তৃপ্তির হাসি।জাহিদ বুঝল মেয়েটাকে পছন্দ হয়েছে তার মায়ের।মায়ের হাসিটার কথা ভেবে বলল,"আমি কি ওনার সাথে একাকি কথা বলতে পারি?"

চৈতির মা অনুমান করেছিলেন এরকম কিছু হতে পারে।আজকাল ছেলেমেয়েরা একা কথা বলবে,নিজেদের বুঝতে চাইবে এটাই তো স্বাভাবিক।তাই তিনি ব্যবস্থা করেই রেখেছিলেন।

চৈতির পিছন পিছন জাহিদ একটা ঘরে ঢুকল।চোখ বুলিয়ে নিল আশেপাশে একবার।দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের বিশাল ছবি।এককোণে রাখা হারমোনিয়াম।বুক শেলফ ভর্তি বই।পরিবেশটা বেশ পছন্দ হল জাহিদের।

চৈতি চুপচাপ বসে আছে।অস্বস্তি বোধ করছে সে।সে কি কথা শুরু করবে কিনা তাও বুঝতে পারছেনা।কিন্তু জাহিদ কে বেশ স্বাভাবিকই দেখা যাচ্ছে।কোন জড়তা নেই।
জাহিদই কথা শুরু করল,"তুমি গান কর?"
চৈতির একটু বিরক্ত লাগে।লোকটা প্রথমেই 'তুমি' বলে সম্বোধন করল!

বলল,"হ্যা করি একটু একটু।"

"তুমি যে একটা ছেলে কে ভালবাস সেটা কি তোমার বাবা মা জানেন?"

জাহিদের এই কথায় চৈতি অপ্রস্তুত হয়ে যায়।অবাক হয়ে জাহিদের দিকে তাকালো সে।জাহিদ আবার জিজ্ঞেস করল,"জানেন?"

চৈতি মাথা নাড়ে,"না।কিন্তু আপনি জানলেন কি করে?"

জাহিদের মুখে মৃদু হাসি।বলে,"তোমাকে দেখে অনুমান করছি।তোমার চেহারাই বলে দিচ্ছে এই বিয়েতে তোমার মত নেই।তুমি আমাদের সামনেও আসতে চাচ্ছিলেনা বোধ হয়।এসবের একটাই কারণ থাকতে পারে তা হল তুমি কাউকে পছন্দ কর।"

"হ্যাঁ আমি একজন কে পছন্দ করি।"

"তাহলে বাবা মাকে বলনি কেন?"

"আসলে বাবা আমাকে না জানিয়েই আপনাদের সাথে কথা বলেছেন।আর ও এখনো বেকার।একটা বেকার ছেলের সাথে কেন বাবা তার মেয়ের বিয়ে দেবে কেন?"

জাহিদ তার কার্ড বাড়িয়ে দিল চৈতির দিকে।বলে,"কালই ওকে আমার সাথে দেখা করতে বল।দেখি আমি কিছু করতে পারি কিনা।আমি যদিও একটা কলেজের টিচার।কিন্তু পরিচিত লোকজন কম না।ব্যবস্থা একটা করতে পারব মনে হয়।"

"আপনি কেন ওর চাকরির ব্যবস্থা করবেন?"

"বড় ভাই কি ছোট বোনের জন্য এটুকু করতে পারেনা?"

চৈতির মুখে হাসি খেলে যায়।মস্ত বড় একটা ভার থেকে মুক্ত হয় সে।কি করবে বুঝে উঠতে পারেনা।হঠাৎ সে উঠে জাহিদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে!

"কি ব্যাপার হঠাৎ তুমি আমাকে সালাম করলে কেন?"

"ছোট বোন কি বড় ভাইয়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে পারেনা?"

দুজনেই হেসে ওঠে।চৈতি এখন অনেকটা নিশ্চিন্ত হল।কিছুক্ষন আগের সেই অস্বস্তিটা নেই এক্ষণ।

চৈতি বলে,"আপনারও নিশ্চই পছন্দের কেউ আছে তাইনা?"

"হ্যাঁ আছে।"

"তাহলে তাকে বিয়ে করছেন না কেন?"

"তাকে বিয়ে করা সম্ভব না।"

"কেন,তার কি বিয়ে হয়ে গেছে?"

"না।"

"তাহলে ফ্যামিলিতে কোন সমস্যা আছে?"

"না।আমার মাকে বললে আমার মা সানন্দে প্রস্তাব নিয়ে যেত।আর পাত্র হিসেবেও নিশ্চই আমি খারাপ না,কি বল?"

"তাহলে সমস্যা কোথায়?"

"ওকে বিয়ে করা যাবেনা কারণ ২ মাস আগে একটা রোড অ্যাক্সিডেন্টে ও মারা গেছে।"
জাহিদ বেশ সহজ ভাবে কথা গুলো বললেও বলার পর যেন জমে গেল।শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল জানালার বাইরে।

চৈতি কোন কথা বলতে পারছেনা।সে এরকম কিছু আশা করেনি।জাহিদ নামের এই লোকটার প্রতি তার মায়া হচ্ছে।কত সহজে কথা গুলো বলে দিল মানুষটা।চৈতি বলে,"আমি দুঃখিত।"

"তোমার দুঃখিত হবার কিছু নেই চৈতি।তুমি কালই ওকে আমার সাথে দেখা করতে বল।দেখি কি করা যায়।"এটা বলে উঠে এল জাহিদ।পরে কথা বলবে বলে সেদিন রওশন সাহেবের বাসা থেকে চলে এল জাহিদ আর ওর মা।জাহিদের কথায় কিছুদিন পর জাহানারা বেগম জানিয়ে দিলেন বিয়েতে মত নেই ছেলের।


                                                          ####

জাহিদের আজ বড্ড বেশি খারাপ লাগছে।বারবার এক বছর আগের এই দিনটির কথা মনে পড়ছে।কি মধুর ছিল সেসব দিন।ঠিক যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোন রূপকথার গল্প।জাহিদের কঠিন হৃদয়ের পটে আঘাত করছে সেই সব স্মৃতি গুলো।

নিলিমার সাথে একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে পরিচয় হয়েছিল তার।চমৎকার গাইতে পারত মেয়েটা।সেই অনুষ্ঠানে নাটকও করেছিল ওরা একসাথে।একটা অদ্ভুত আকর্ষনি ক্ষমতা ছিল নিলিমার।কেমন একটা মায়ায় ছেয়ে থাকত যেন মেয়েটি।জাহিদের ওকে খুব ভাল লেগে যায়।কিন্তু পড়াশুনায় সিরিয়াস জাহিদ এসব বেশি আমলে নিলনা।তাই ওটা 'ভাল লাগার' মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকল।

কিন্তু নিলিমার মন ভাল লাগা ছাড়িয়ে আরো অনেক দূর চলে যায়।কিন্তু কিভাবে বলবে জাহিদ কে সে এই কথা?শেষ পর্যন্ত থাকতে না পেরে জাহিদ কে বলে দেবে বলেই ঠিক করল।কিন্তু কিভাব?

এক বছর আগেই এই দিনটির কথা ভাবে জাহিদ।সেদিন নিলিমা আকাশি নীল রঙের শাড়ি পড়েছিল।তাকে বলেছিল যেন পাবলিক লাইব্রেরির সামনে আসে।কি যেন জরুরী কথা আছে।
নিলিমাকে আসতে দেখে জাহিদ বুকের মধ্যে একটা কাপন টের পেল।নীল শাড়িতে ওকে অসাধারণ লাগছে।ওর হাতে ফুল।তবে কি...

"কি ব্যাপার এত সাজগোজ করে,ফুল নিয়ে কোথায় যাওয়া হচ্ছে?"

নিলিমা বলল,"আপনার কাছে একটা পরামর্শের জন্য আপনাকে দেখা করতে বলেছিলাম।"

"হ্যাঁ বল।"

"আসলে আমি একজন কে খুব ভালবাসি।কিন্তু তাকে কোন ভাবে বলতে পারছিনা।আজ বলবই যেভাবে হোক।কিভাবে বলি বলুন তো?"

জাহিদের হঠাৎ মনে হল কেউ তাকে আঘাত করেছে।একটা কষ্ট অনুভূত হল ওর।জাহিদ ভাবছে আমি কেন কষ্ট পাচ্ছি?ও তো আমার কেউ না।আমার কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই।ওর কাউকে ভাল লাগতেই পারে।
মুখে হাসি টেনে বলল,"ও এই ব্যাপার।আপনি সরাসরি তার কাছে যান।তারপর তার দিকে হাতের ঐ গোলাপ গুলো বাড়িয়ে দিলেন।সাহস করে স্পষ্ট ভাবে বলুন 'আমি তোমাকে ভালবাসি'। I love you বলবেন না কিন্তু,বাংলায় আমি তোমাকে ভালবাসি বলবেন।তারপর বলবেন 'তুমি যদি আমায় ভালবাস তাহলে এই গোলাপ গুলো গ্রহন কর।'মনে রাখবেন কাউকে ভাল লাগলে সাহস করে বলে দিতে হয়,না হলে পরে পস্তাতে হয়।কি হল আমাকে জানাবেন।আমার একটা ক্লাস আছে,আসি এখন।"

জাহিদ দাড়ালো না।ওর কেমন যেন কষ্ট হচ্ছিল।হঠাৎ শুনল নিলিমার গলা, "এই যে শুনুন।"

নিলিমা জাহিদের সামনে এসে দাড়ায়।তারপর কাপা কাপা গলায় বলে,"আমি তোমাকে ভালবাসি।তুমি যদি আমায় ভালবাস তাহলে এই গোলাপ গুলো গ্রহন কর।"

নিলিমার হাত কাপছিল।সে তাকাতে পারছিলনা জাহিদের দিকে।জাহিদ যেন মন্ত্র মুগ্ধের মত ওর হাত থেকে গোলাপ গুলো নিয়েছিল।তারপর বলেছিল,
"নিলিমা,আমার দিকে একটু তাকাবে?"

সেদিন ওরা হাতে হাত রেখে সারাটা দিন ঘুরেছিল।সেই হাত নিলিমা কিংবা জাহিদ কেউ ছাড়েনি কখনো।

জাহিদের ভাল রেজাল্টের সুবাদে খুব তাড়াতাড়িই ওর একটা ভাল কলেজে চাকরি হয়ে যায়।কিছুদিন পর হয়তো ভার্সিটিতেও ডাক পড়বে।জাহিদ চাইছিল তাদের সম্পর্কটা পাকাপোক্ত করতে।নিলিমা বলেছিল,
"আপুর শ্বশুড় বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি দু সপ্তাহের জন্য।ফিরে আসি তারপর যা করার কর।"

নিলিমা যে দিন যাবে ঐদিন সারাটা দিন ওরা দুজনে একসাথে ঘুরেছিল।জাহিদের হাতে হাত রেখে কথা দিয়েছিল নিলিমা কোন দিন হারাবে না সে...।
কিন্তু ওদের দুজনের কেউই জানতো না ঐদিনের পরেই হারিয়ে যাবে দুজন দুজনের থেকে,চিরদিনের জন্য।

এরপর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে জাহিদের মা ঠিকই গিয়েছিল তবে নিলিমাদের বাড়িতে না,চৈতি দের বাড়িতে।জাহিদ একটা ঘোরের মধ্যে ছিল।নিলিমা তার জীবন থেকে হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য এটাই সে মেনে নিতে পারছিলনা।এক ফোটা জলও পড়েনি তার চোখ থেকে,কারণ চোখে ছিল শুধুই শূন্যতা,গভির শূন্যতা।


ছাদে বসে এসব কথা ভাবছিল জাহিদ।কখন যে মা পিছনে এসে দাড়িয়েছে টের পায়নি সে।

"একা একা বসে কি ভাবছিস?"
"কিছু না মা।"
"চৈতি মেয়েটাকে তোর ভাল লাগেনি?"
"লেগেছে মা।ও অনেক ভাল মেয়ে।"
"তাহলে না করে দিতে বললি কেন?"
"মা ও আরেকটা ছেলে কে ভালবাসে।আমি দেখেই বুঝেছিলাম।সেদিন যখন আমরা আলাদা কথা বলছিলাম তখনই ও আমাকে বলেছিল।ছেলেটা বেকার ছিল।জাফর সাহেব কে বলে ছেলেটার একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছি।চৈতির সাথে ওর বিয়ের কথা বার্তাও চলছে।এইতো সামনের মাসেই ওদের বিয়ে।"
"তুই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিস?
"হ্যাঁ মা।"
"কেন?"
"আমি নিজে হয়তো সুখি হতে পারবনা কিন্তু অন্য কাউকে তো সুখি দেখতে পারব।"
"এমন কথা কেন বলছিস বাবা?তোর কি হয়েছে?তোর কি কোন পছন্দ আছে?আমাকে বলছিস না কেন?"
"হ্যাঁ মা আছে।"
"ওমা তাহলে আগে বলিস নি কেন?কে সে?ঠিকানা দে।আমি কালই যাব ওদের বাড়িতে।"
"না মা লাভ নেই।"

মাকে সব খুলে বলল জাহিদ।কঠিন হৃদয়ের মানুষ হিসেবে পরিচিত জাহিদ অনেক দিন পর মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদল,বাধ ভাঙা কান্না।


আজ চৈতির বিয়ে হচ্ছে।জাহিদ গিয়েছিল সেখানে।বর কনে দুজনকেই পাশাপাশি বসানো হয়েছে।দুজনের মুখেই অপূর্ব একটা দীপ্তি লক্ষ করেছে জাহিদ।জাহিদ দূর থেকে ওদের দেখে চলে এসেছিল।ওকে দেখলে হয়তো দুটো সুখি মানুষের মুখে ওর দুঃখের ছায়া পড়বে।জাহিদ সেটা চায়না।

প্রতিদিনের অভ্যাস মত রাতে ছাদে হাটছে জাহিদ।আজ পূর্ণিমা।নিলিমা পূর্নিমা খুব ভালবাসত।বলত,"দেখবে আমাদের বিয়েটা যেন পূর্ণিমার রাতে হয়।আমরা দুজন এক সাথে চাঁদের আলোতে বসব।আমার মুখে জোছনার আলো পড়বে।সেই আলোতে তুমি আমাকে দেখবে।"

নিলিমার ছবিটা বেড় করে জাহিদ।চাদের আলোতে ধরে সেটা।জোছনার আলোতে দেখতে থাকে নিলিমাকে।নিলিমার মৃত্যুতেও যেটা হয়নি ওর,সেটাই হয়।চোখ ফেটে কান্না আসে ওর।বিশাল আকাশের নিচে নিঃসঙ্গ লাগে নিজেকে।শব্দ করে কেঁদে ওঠে জাহিদ।

কিন্তু ওর সেই কান্না কেউ শুনতে পায়না,কেউ না।






১৮/২/২০০৯
রাফি শামস

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন