Powered By Blogger

বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যে

শিরোনাম দেখেই বুঝতে পারছেন কি বিষয়ে লিখছি।তবে আমি কোন গবেষক নই।একজন উৎসাহি পাঠক বলতে পারেন।বেশ কিছুদিন আগেই আমি একটা বই পড়েছিলাম-'ইতিহাসের রক্ত পলাশ পনেরই আগস্ট পচাত্তর'।
লিখেছেন আবদুল গাফফার চৌধুরী।চিনতে পেরেছেন এনাকে?
'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী'-গানের গীতিকার যিনি ২১ ফেব্রুয়ারী ১৪৪ ধারা ভংগের সেই মিছিলে গুলি বিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছিলেন।পরবর্তীতে তিনি সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন।মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে'-কর্মরত ছিলেন।তিনি বঙ্গবন্ধুর একজন প্রকৃত শুভাকাংখি ছিলেন যিনি সরকারের কোন কাজ পছন্দ না হলে সরাসরি সমালোচনা করতে কিংবা তা নিয়ে পত্রিকায় লিখতে দ্বিধা করতেন না।তাই তার লেখা বইটি যে প্রভাব মুক্ত এবং সত্য সেটা স্পষ্ট।
আমি অনেক খুজেও বইটি ইন্টারনেটে পাইনি।কিন্তু আমার মনে হয়েছে বই টি সবার পড়া দরকার।কারণ এতে করে অনেক অমীমাংসিত ব্যাপার,অনেক প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার হবে।সেই সময়ের ঘটনা এবং বঙ্গবন্ধু কে কেন নিহত হতে হল সেই প্রেক্ষাপট বিস্তারিত বোঝা সম্ভব হবে।আমি যেহেতু বইটির কোন লিঙ্ক দিতে পারছিনা তাই আমার ইচ্ছা বইটি থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু অংশ নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে সবাই কে জানাবো।
আজ বইয়ের মাঝামাঝি জায়গা থেকে শুরু করব।মুজিব চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন মস্কো তে।সেখান থেকে এসে গেলেন ইন্দিরা গান্ধির সাথে দেখা করতে।অপর দিকে ঠিক একই সময় ভুট্টো গেলেন পিকিং এ।অর্থাৎ একদিকে ভারত-বাংলাদেশ-রাশিয়া অন্য দিকে পাকিস্তান-চিন-আমেরিকা।
দেশে ফিরে গাফফার চৌধুরীর সাথে এ বিষয়ে তার কথোপকথন হয়।তার কিছু উল্লেখযোগ্য অংশ তুলে দিচ্ছি।
"বঙ্গবন্ধু বললেনঃবাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়ায় ভারত উপমহাদেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে গেছে।এই বাস্তবতা নিক্সন আডমিনিস্ট্রেশন মেনে নিতে পারছেনা।তারা চেয়েছিল পাকিস্তান ও বাংলাদেশ কে মিলিত ভাবে তারা ভারত মহাসাগরে নৌঘাটি স্থাপন ও ভারতে সোভিয়েত প্রভাব হ্রাসে ব্যবহার করবে।ভারত ও সোভিয়েত ইয়ুনিয়ন মিলিত ভাবে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা লাভে সাহায্য করায় তাদের এই পরিকল্পনা ভন্ডুল হয়ে গেছে।পাকিস্তানের সাথে জয় লাভ করায় ভারত এশিয়ার সাব-সুপার পাওয়ার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে।এটা আমেরিকা চিন কারোরি মনঃপূত ন্য।পরাজিত ও দুর্বল পাকিস্তান কে দিয়ে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়।এজন্য চীন কে সঙ্গে টানা হয়েছে।অন্যদিকে ভারতের অভ্যন্তরে ডানপন্থী ও সাম্প্রদায়িক দল গুলোকে সাহায্য জুগিয়ে ইন্দিরা সরকার কে অপসারণের চেষ্টা চালানো হচ্ছে।"
এরপর বঙ্গবন্ধু বর্ননা করেন কিভাবে মার্কিন সরকার একটা দেশের সরকারের পতন ঘটানোর কাজ করে।আমি নিজের ভাষায় সেটা সহজ করে বলছি।মার্কিনীদের সিআইএ এই কাজ টি করে থাকে।প্রথমে তারা বুদ্ধিজীবী,সাংবাদিক ও প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যম গুলোকে হাত করে,তাদের এজেন্ট বসিয়ে তার মাধ্যমে সরকারের বিরূদ্ধে মিথ্যা,অর্ধ-সত্য কথা প্রচার করে।এরপর দেশের শ্রমিক শ্রেণী কে উসকে দিয়ে দেশে অস্থিতিশীল অবস্থার তৈরি করে।এই কাজে সাহায্য করে দেশের মধ্যে থাকা ক্ষমতালোভী রাজনীতিবিদ ও সাম্প্রদায়িক মহল।এভাবে তারা ক্রমান্বয়ে সরকারের জনপ্রিয়তা কমাতে থাকে।যখন সরকার জনপ্রিয়তা হারায় তখন গণতন্ত্র রক্ষার নাম করে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সরকারের পতন ঘটায়।বিষয় ট আরো জটিল ও প্যাচালো।আমি সাধারণ ভাবে মূল বিষয় টি বললাম।
আমরা যদি অতি সাম্প্রতিক ঘটনা গুলো দেখি(মিশরের ঘটনা,আরব-বসন্ত,লিবিয়া ইত্যাদি) এবং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ড ও দেখি তাহলে বুঝব ঠিক এই ঘটনা গুলোই ঘটেছে।স্বয়ং বঙ্গবন্ধু এটা বুঝেছিলেন এবং তার প্রতিকার ও করতে চেয়েছিলেন।আবার বই এ ফিরে যাই।
"বঙ্গবন্ধু বলছেনঃভারতে যদি গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটে তাহলে সারা এশিয়ায় মিলিটারী-ফ্যাসিজম প্রতিষ্ঠা হবে।চলবে যুদ্ধ,অস্ত্র প্রতিযোগীতা।সামরিক খাতে বিনা প্রয়োজনে কোটি কোটি টাকা খরচ হবে।জনসাধারণের ভাগ্য উন্নয়ন,দারিদ্র্য বিমোচনের পরিকল্পনা হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।যদি দরকার হয় কিছুদিনের জন্য রাজনৈতিক এক নায়কত্ব প্রতিষ্ঠার দ্বারা এই মিলিটারি-ফ্যাসিজম এর অভিশাপ রুখতে হবে।
শেষ কথাটি খেয়াল করুন।আজীবন ক্ষমতায় থাকার বাসনায় নয়,তৎকালীন বিরূপ পরিস্থিতি সামাল দিতেই তিনি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলান।
পরবর্তী কথা গুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ।খেয়াল করুন-


আমি অবশ্য সব রকম একনায়কত্বের বিরোধী।কিন্তু রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি বলেও একটা কথা আছে।শহীদ সোহরাওয়ার্দী বেঁচে থাকতেই আমি সমাজতন্ত্র বিশ্বাসি হয়েছি।কিন্তু আওয়ামি লীগের লক্ষ সমাজতন্ত্র এই কথাটি বলার জন্য আমাকে ১০ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে।গণতন্ত্র আমার লক্ষ।কিন্তু তা দ্বি-দলীয় সেক্যুলার গণতন্ত্র বা যার যা খুশি করার গণতন্ত্র নয়।সাম্প্রদায়িক শ্লোগান বিনা বাধায় তোলার অধিকার দেয়াকে আমি গণতান্ত্রিক অধিকার বলে মনে করিনা।উন্নত দেশে গণতান্ত্রিক সরকারের কাজ আরো একটি,জনসাধারণকে গণতান্ত্রিক চেতনা ও শিক্ষায় আরো শিক্ষিত করে তোলা।এজন্য দরকার হলে একটি অনুন্নত দেশে গণতান্ত্রিক সরকারকে সময় সময় অত্যন্ত কঠোর হতে হবে।মিলিটারি ফ্যাসিবাদের চাইতে রাজনৈতিক একনায়কত্ব সাময়িক ভাবে ভাল এজন্য যে,রাজনৈতিক একনায়কত্বের ভিত্তি জনগণ ও জনগনের রাজনীতি।সুতরাং জনগণের সমর্থন ও ভাল-মন্দের দিকে তাঁকে লক্ষ রাখতে হবে।অন্যদিকে মিলিটারি এর শক্তি হল অস্ত্র ও সমাজের প্রগতি-বিরোধী শক্তি।এই দুয়ের মিলনে কোন দেশের ই মঙ্গল হতে পারেনা।

আজ আর বেশি দীর্ঘ করছিনা।এর পরে লিখব খন্দকার মুশ্তাকের সাথে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক ও তাজ-উদ্দীন আহমেদ কে নিয়ে।
আজকে আমি এই অংশ টুকু সামনে নিয়ে এলাম এটা দেখানোর জন্য,যারা বলেন মুজিব ক্ষমতার লোভে একনায়কত্ব তথা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেছে তারা কিছু না জেনেই নিছক শোনা কথা বলেন।সত্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা বা এগুলো নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে চান না।সে সময় কেন বাকশাল হল,কেন অনেক পত্রিকা বাতিল করা হল-সব প্রশ্নের উত্তর ই আমি দেয়ার চেষ্টা করব।কেউ যেন মনে না করেন আমি মন গড়া কথা লিখছি কিংবা একটি মাত্র বইয়ের উপর নির্ভর করছি।লেখা শেষ হবার পর আমি সব গুলো সূত্র উল্লেখ করব।
সবাই হয়তো কষ্ট করে বইটা পড়বেন না,তাই আমি ঠিক করলাম বিশেষ বিষয় গুলো সামনে নিয়ে আসব।কারণ অপপ্রচারের জবাব সত্য তথ্য দিয়েই দিতে হয়।
জয় বাংলা...জয় বঙ্গবন্ধু

 বঙ্গবন্ধু কেন নিহত হলেন,ঐ সময়ের প্রেক্ষপট কি ছিল,সেই সময় তাঁর সম্পর্কে যে কথা গুলো শোনা যায় তা কতটুকু বাস্তব।নিছক আগ্রহ থেকে বিভিন্ন বই-পত্র থেকে আমি সেগুলো জানার চেষ্টা করেছি।এই জানার পথেই পেয়েছি ঐ সময়ের বংবন্ধুকে খুব কাছ থেকে দেখা একজন মানুষ আবদুল গাফফার চৌধুরী(আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গানের লেখক) এর লেখা 'ইতিহাসের রক্ত পলাশ পনেরই আগস্ট পচাত্তর'-নামের বইটি

গত লেখায় আমি বলেছিলাম তৎকালীন উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাধ্য হয়ে পরিস্থিতি সামাল দেবার জন্য সাময়িক ভাবে বঙ্গবন্ধু কেন একনায়ক তন্ত্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা ভাবনা করছিলেন এবং সে সংক্রান্ত কি কথোপকথন চৌধুরীর সাথে তাঁর হয়েছিল।বইটির একটি জায়গায় খন্দকার মুশতাক আহমেদের ভূমিকা,বঙ্গবন্ধুর সাথে তার সম্পর্ক এবং তাজউদ্দীন আহমেদের ভূমিকা নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।বলেছিলাম সেটা নিয়ে আজকের লেখা।
খন্দকার মুশতাক আহমেদের সাথে ইতিহাসের মির জাফরের তুলনা হয়।তাদের কাজ কর্ম তো বটেই লেখক বলেছেন দুজনের শারীরিক গড়নেও নাকি সাদৃশ্য ছিল ! মুশতাক পল্টিবাজ রাজনীতিবিদ ছিল (ইচ্ছা করেই আমি 'ছিলেন' ব্যবহার করছি না)।
সুবিধাবাদী হিসিবে রাজনৈতিক জিবনের শুরু থেকেই দল বদল করেছে সে।নীতি ও আদর্শের দিক থেকে সে ছিল ডান পন্থি,সাম্প্রদায়িক ও মার্কিন ঘেষা।
লেখক বইয়ের ১৩ তম পরিচ্ছেদে বলেছেন মশতাক সম্পর্কে।সেখান থেকে হুবহু তুলে দিচ্ছি।
"মুজিব জননি বেগম সাহেরা খাতুন মারা গেলেন ৩১ মে বিকালে।সেদিন সন্ধ্যায় আমাকে খবর টা জানালেন এম,আর আখতার মুকুল।শেখ মুজিব গেলেন টুংগি পাড়ায় মাকে দেখার জন্য।শেষ দেখা।সঙ্গে জুটলেন দুই মন্ত্রি-খন্দকার মুশতাক আহমেদ ও তাহের উদ্দিন ঠাকুর।
শেখ মুজিব তাঁর মায়ের জন্য যত কাঁদলেন না,তার থেকে বেশি কাঁদলেন মুশতাক।সেই দৃশ্য দেখে আমি প্রথমে ভুল বুঝেছিলাম।ভেবেছিলাম মুশতাকের কেউ সম্ভবত মারা গেছে।শেখ মুজিবের একজন দেহরক্ষি কে কথাটা জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেনঃনা না উনি বঙ্গবন্ধুর মায়ের মৃত্যুতে কাদছেন।
শুধু কেঁদেই মুশতাক ক্ষান্ত হলেন না।শেখ মুজিবের সঙ্গে গেলেন টুংগি পাড়ায়,সারা পথ নিজেই কাঁদলেন।
শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের শাসনামলে মুশতাক ছিলেন তাঁর একেবারে ছায়া সহচর।তার মনে যাই থাকুক ,মুজিবের সামনে তিনি থাকতেন বান্দা হাজির মনভাব নিয়ে।মন ভেজানো কথা বলতেন।
একবার দৈনিক 'জনপদ'এ আমার একটা লেখায় মুজিব চটে গিয়ে আমাকে গণভবনে ডেকে পাঠালেন।গিয়ে দেখি মুশতাক বসে আছে।'জনপদের' বিরূদ্ধে দু-একটা কথা বললেন মুজিব কে খুশি করার জন্য।আবার এই মুশতাক ই বাইরে দেখা হলে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন।মুজিবের কোন কোন কাজের সমালোচনা করার জন্য আমার প্রশংসা করেছেন।বিচিত্র এই মুশতাক চরিত্র।
মুশতাকের রাজনৈতিক চরিত্রেও স্থিরতা বলে কিছু নেই।১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নোমিনেশন না পেয়ে প্রথম হক ভাসানীর নেতৃত্বের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন।আওয়ামি লীগ কে যখন অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান রূপে পুনর্গঠন করার জন্য মুজিব-ভাসানী এক যোগে কাজ করছেন,তখন তিনি আওয়ামি লীগ থেকে ত্যাগ করেন এবং আওয়ামি লীগের ডানপন্থি ও সাম্প্রদায়িক অংশের সাথে হাত মিলিয়ে আওয়ামি মুসলিম লীগ গঠনের চেষ্টা করেন।
আইন পরিষদে সরকারি হুইপ হবার লোভে আবার তিনি আওয়ামি পার্লামেন্টারি পার্টির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেন এবং কৃষক শ্রমিক পার্টির সরকারে গিয়ে ঢোকেন।
সারা জীবন তিনি প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থি ও সাম্প্রদায়িকতাবাদ কে সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু ব্যক্তিগত সমর্থন লাভের জন্য আওয়ামি লীগের প্রগতিশীল অংশের সাথে থেকেছেন।প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠি তাকে ট্রয়ের ঘোড়ার মত প্রগতিশীল অংশে ব্যবহার করেছে।"
উপরের অংশ থেকে আমরা মুশতাকের রাজনৈতিক চরিত্র বুঝতে পারলাম।এবার মুক্তিযুদ্ধের সময় তার ভূমিকা নিয়ে আলোকপাত করছি।
"মুশতাকের সব থেকে বড় বিশ্বাস ঘাতকতা ১৯৭১ এ।তিনি মুজিব নগরে বসে মাহবুব আলম চাষী,তাহের উদ্দিন ঠাকুর প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে একটি চক্র তৈরি করেন এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে গোপন যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেন।মুক্তিযুদ্ধ বানচাল করে পাকিস্তানের সাথে কনফেডারেশন গঠন করাই ছিল তাদের লক্ষ।
মুক্তিযুদ্ধ যখন পূর্ণাংগ রূপ নিতে চলেছে তখন মুশতাক গ্রুপ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য একটি প্রচারপত্র বিলি করে।এই প্রচার পত্র টির শিরোনাম ছিল ইন্ডিপেন্ডেন্স অর মুজিব? মুজিব না স্বাধীনতা? এই প্রচার পত্র টির মূল বক্তব্য ছিল
আমরা যদি পাকিস্তানের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধ করি তাহলে পাকিস্তানীরা কারাগারে মুজিব কে হত্যা করবে।শেখ মুজিব ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্থহীন হয়ে যাবে।সুতরাং স্বাধীনতার আগে মুজিবের মুক্তি দরকার এবং মুক্তির পর পাকিস্তানের সাথে আলোচনা দরকার।
এই প্রচার পত্রের মাধ্যমে মুশতাক এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছিলেন।তারা প্রচার করছিল যে তাজউদ্দিন চাইছেন না মুজিবের মুক্তি হোক।তিনি চান মুজিব কে সড়িয়ে নিজেই রাষ্ট্রপ্রধান হতে।"
তাজউদ্দীনের বিরূদ্ধে প্রচারণা তখন থেকেই শুরু।এই প্রচার পত্রে মুক্তিযোদ্ধা দের মধ্যে ব্যাপক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।এই প্রচারণায় মুজিব পরিবারের অনেকে বিভ্রান্ত হন।এমন কি মুজিব দেশে ফেরার পর ও তাঁকে বলা হয় যে তাজ-উদ্দীন তাঁকে সড়িয়ে,পাকিস্তানে তার মৃত্যু ঘটিয়ে দেশের ভাগ্যবিধাতা হতে চেয়েছিলান।লেখক বলেছেন,
"বঙ্গবন্ধু এই অপপ্রচার বিশ্বাস করেছিলেন কিনা,আমার জানা নেই।"
মুশতাকের আরো অপকর্ম আছে।ঐ সময় সে বিদেশে যুদ্ধ বিরোধী প্রচারণা চালায়।বিভিন্ন পত্রিকায় বিভ্রান্তি কর বিজ্ঞপ্তি পাঠায়।বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর মশতাক গ্রুপের বিচার হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তাজ-উদ্দীন তাকে ক্ষমা করে।
আবার বই এ ফিরে যাই।
"১৯৭২ সালে মুজিব দেশে ফিরে এসে মুশতাক ও তার সাঙ্গোপাঙ্গো দের ক্ষমা করে দেন।১৯৫৫ থেকে একবার নয়,বারবার মুজিব ক্ষমা করেছেন মুশতাক কে,ভুলে গেছেন বিশ্বাস ঘাতকতা...।
শেখ মুজিবের মায়ের মৃত্যুতে যিনি কেঁদে চোখ ফুলিয়েছিলেন,মাত্র এক বছরের ব্যবধানে সেই মুজিবের এবং তাঁর স্ত্রী-পুত্র পরিবারের নৃশংস হত্যা কান্ডে উল্লাস প্রকাশ করে হত্যাকারি দের খেতাব দিলেন 'সূর্য সন্তান' এবং এই বর্বরতা কে আখ্যা দিলেন ঐতিহাসিক প্রয়োজনীয়তা বলে।
আরো বিস্ময়ের কথা যে ঢাকায় যে বাড়িতে বসে মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্রের সূত্রপাত ঠিক সেই এলাকার খুব কাছের একটি বাড়িতে বসে আড়াইশো বছর আগে সিরাজ হত্যার ষড়যন্ত্র করা হয়।"
এখানে হয়তো অনেকের প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক,মুজিব কেন বারবার মুশতাক কে ক্ষমা করেছেন?শুধু মুশতাক কে না আরো অনেক কেই তিনি ক্ষমা করেছেন।এটাই হল মুজিবের সব থেকে বড় দুর্বলতা।যার চরম বিনিময় তাঁকে দিতে হয়েছে।মুজিবের এই ক্ষমা করার ঘটনা লিখব এর পরের পর্বে।
তাজ-উদ্দীন আহমেদ ছিলেন মুজিবের যোগ্য সেনাপতি।তিনি না থাকলে মুজিব বিহীন ৭১ এ বাংলাদেশ সৃষ্টি হত না।তিনি কখনই মুজিব কে সড়িয়ে নেতা হতে চাননি।ছায়ার মত বঙ্গবন্ধুর সাথে থেকে কাজ করে গেছেন।তাজউদ্দীন কে পাকিস্তানি শাসকেরাও ভয় পেতেন।তার একটি ঘটনা লেখক আমাদের জানাবেন।
"১৯৭১ সালে মুজিব ইয়াহিয়ার বৈঠকের রূদ্ধশ্বাস দিন গুলোর কথা।ভুট্টো এসেছেন ঢাকায়।আমরা কজন সাংবাদিক তাঁর সাথে দেখা করার অনুমতি পেয়েছি।আমাদের বেশি কিছু বলতে চাইলেন না।আমাদের উপস্থিতি ভুলে গিয়ে তাঁর এক সহকর্মীকে উর্দুতে বলে উঠলেনঃ আলোচনা বৈঠকে আমি মুজিব কে ভয় পাইনা।ইমোশনাল এপ্রোচে মুজিব কে কাবু করা যায়।কিন্তু তাঁর পিছনে ফাইল-বগলে চুপচাপ যে 'নটরিয়াস' লোকটি দাঁড়িয়ে থাকে তাকে কাবু করা শক্ত।দিস তাজুদ্দীন,আই টেল ইউ,উইল মাইট বি ইউর মেইন প্রবলেম।
আমি সঙ্গে সঙ্গে কথাটি নোট বুকে টুকে নিলাম।তখন বুঝতে পারিনি,কথাটি একদিন কত বড় ঐতিহাসিক সত্য হয়ে দাঁড়াবে।"
তাজুদ্দীন কে ভুট্টো ক্ষমা করেন নি।১৯৭১ এ যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানি দের পক্ষ থেকে ঢাকায় একটি প্রচারপত্র বিলি করা হয়।তাতে বলা হয়,
"

তাজুদ্দিন আসলে ভারতীয় ব্রাহ্মন।মুসলমান নাম গ্রহণ করে তিনি আওয়ামি লীগে ঢুকেছেন পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় ষড়যন্ত্র সফল করার জন্য।"
১৯৭৫ সালে তাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে জেলে হত্যা করা হল।রটানো হল-তিনি জেলে বসে ভারতীয় কমিশনার কে গোপনে চিঠি পাঠিয়েছিলেন ভারতীয় সেনা বাহিনি আনার জন্য।
আজ আর দীর্ঘ করবনা।আজকে আমি মূলত তুলে ধরতে চেয়েছি মুশতাকের মত মির জাফরের ভূমিকা ও মুজিবের যোগ্য সেনাপতি তাজ-উদ্দিনের কিছু কথা।ঘটনা ক্রমে এদের দুজন ই আরো আসবেন সামনে।এরপরের লেখায় আমি তুলে ধরতে চেষ্টা করব মুজিবের ক্ষমা শীলতার কিছু উদাহরণ যা ছিল তাঁর বড় বড় ভুল এবং তাঁর বিরূদ্ধে কিছু অপপ্রচার এর জবাব দেয়ার চেষ্টা করব।
অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটা বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই।
আজ আমি যেসব অপপ্রচারের কথা তুলে ধরেছি সেগুলো কি খুব পরিচিত না?
আজো এই ধরণের প্রচারণা চালিয়েই জামাত-শিবির ও তাদের দোসর রা আমাদের সাধারন মানুষ কে বিভ্রান্ত করে চলেছে না?
আগের অপপ্রচার গুলো রোধ করা গেলে হয়তো মুজিব-তাজুদ্দিনের এই পরিণতি ভোগ করতে হতনা।
আমরা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি চাইনা।
তাই এখন যে অপপ্রচার গুলো চলছে তা রোধ করা ও এর জবাব দেয়া আমাদের সবার নাগরিক দায়িত্ব।
জয় বাংলা,জয় বঙ্গবন্ধু...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন