Powered By Blogger

নিষিদ্ধ!!

ঠিক এই শিরোনামেই একবার রহস্য পত্রিকায় একটা ফিচার ছাপা হয়েছিল।মূল্য বৃদ্ধির কারণে রহস্য পত্রিকা পড়া অনেক আগেই বাদ দিয়ছিলাম,তবে ঐ শিরোনামটি দেখে সেই পত্রিকাটি কিনেছিলাম।আমার কিশোর মস্তিষ্ক 'নিষিদ্ধ' শব্দটি দেখেই উত্তেজিত হয়েছিল কোন নিষিদ্ধ জ্ঞান লাভের আনন্দে!তবে ফিচার লেখক শব্দ টা ব্যবহার করেছেন একটা 'ট্রিক্স' হিসেবে।তিনি দেখিয়েছেন কেবল মাত্র এই শব্দটি ব্যবহারের কারণেই তার এই ফিচারটি অনেকে পড়বে।আমাদের দেশে যৌনতা সংক্রান্ত স্বাভাবিক ব্যাপার গুলোও ট্যাবু করে রাখা হয়,ফলে আমাদের এখানে নিষিদ্ধ মানেই যৌনতা সংক্রান্ত বিষয়!কিন্তু আমাদের শাসক শ্রেণীর কাছে নিষিদ্ধ মানে আরও ভয়াবহ কিছু!
মানুষের মুক্তির সব থেকে বড় হাতিয়ার হল জ্ঞান।আর এই জ্ঞান লাভের ক্ষেত্রে বই এর বিকল্প আর কি হতে পারে?সব বই ই যে জ্ঞানের আধার,এমন কোন কথা নেই।ছাপার অক্ষরে কিছু লেখা হলেই সেটাকে জ্ঞান বলা যায়না।আমাদের দেশে নেতা-নেত্রীদের চাটুকারেরা বিভিন্ন নেতা নেত্রির সুনাম করে এক ধরণের বই লেখেন।এর থেকে অখাদ্য আর কিছু হতে পারেনা।আর এক ধরণের বই আছে যেগুলোতে নারী কে কিভাবে ইসলাম সম্মত ভাবে চলতে হবে তার ভয়াবহ বর্ননা দেয়া আছে!এগুলোর মত অশ্লীল বই আরও বেশি অখাদ্য!তবে সাধারণ এর পাশাপাশি মাঝে মধ্যে দু একজন 'বোকা' মানুষ ভয়াবহ কিছু লিখে ফেলেন অনেক সময়।যা শাসক শ্রেণী কিংবা ধর্মবেত্তাদের ভিত্তি নাড়িয়ে দেয়।এগুলোর ভয়ে,এগুলোর সাথে পেরে না উঠে সেই বই কেই নিষীদ্ধ করে দেয় তারা!
বাংলাদেশে স্বাধিনতার পরে এই নিষিদ্ধের তালিকায় পড়েছেন মূলত দুজন-হুমায়ুন আজাদ,তসলিমা নাসরিন।বেশির ভাগ অন্ধ হুমায়ুন আজাদের বই না পড়েই তাঁর বিরূদ্ধে ক্রোধে মত্ত হয়ে যায়।ধর্ম নামক মাদকের আসক্তি এতই প্রবল যে এর জন্য জীবন দিতেও কুন্ঠা বোধ করেনা তারা,কুন্ঠা বোধ করেনা অন্য কারও জীবন নিতেও!আর তসলিমা নাসরিনের কথা কি বলব।তিনি তো অনেকের কাছেই (যারা নিজেদের আলোকিত বলেও দাবি করে) চরম ঘৃণার পাত্র!তসলিমা নাসরিন কে এদেশ থেকেই তো বের করে দেয়া হল।অবশ্য দেশে থাকলে তাকে হয়তো পৃথীবি থেকেই বের করে দেয়া হত-হুমায়ুন আজাদের মত।তাদের লেখার জবাব দেয়ার মত জ্ঞান,পান্ডিত্য,মেধা কোনটাই শাসক শ্রেণী বা ধর্মবেত্তা দের নেই।না থাকাটাই স্বাভাবিক!কিন্তু কেন এই ভয়?

হুমায়ুন আজাদের যে বইটি নিষিদ্ধ হয়েছে,সেটি হল- 'নারী'।নারী বইটি একটি গবেষনা গ্রন্থ।বাংলা ভাষায় শুধু না,পৃথীবিতে এমন বই খুব কমই লেখা হয়েছে।তবে এই বইটির থেকেও অনেক গুরুতর বই হুমায়ুন আজাদ লিখেছেন যা কিনা ধর্মরক্ষাকারীদের একেবারে মূলে আঘাত করেছে।'পাক সার জামিন সাদ বাদ' এ তিনি যেভাবে মৌলবাদীদের 'ধুয়ে' দিয়েছেন তাতে বইটি নিষিদ্ধ হতে পারত।'শুভব্রত তার সম্পর্কিত সুসমাচার' বইটি তে শুভব্রত চরিত্রটির সাথে হযরত মুহম্মদ (স) এর মিল খুজে পাওয়া যায় এবং এই বইতে তিনি খুব সুন্দর করে উপন্যাসের মধ্য দিয়ে ধর্মের মূল স্বরূপটি উন্মোচন করেছেন।আমাদের ধর্ম রক্ষাকারী জেহাদি ভাইয়েরা বই পত্র খুব একটা বেশি পড়েন না বলে হয়তো এই দীর্ঘ উপন্যাসটি তারা পড়েন নি!এই বইটিও নিষিদ্ধ হতে পারত।কিন্তু নিষিদ্ধ হল 'নারী'।কেন?
নারী বইতে হুমায়ুন আজাদ শুধু ধর্মেরই না,পুরুষতান্ত্রিক প্রতিটা ক্ষেত্রে কঠিন ভাবে আঘাত করেছেন।এর প্রতিটা বাক্য যৌক্তিক,যা একজন কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবেই।তাই খুব সম্ভবত বইটি কেবল ধর্মব্যবসায়িদেরই নয়,সকল শ্রেণীর-যারা পুরুষতান্ত্রিকতা কে লালন করে তাদের রোষানলে পড়েছিল।বইটি নিষিদ্ধের সাড়ে ৪ বছর পর হাইকোর্টের রায়ে এর নিষিদ্ধাদেশ বাতিল হয়।সেই সাথে আইনত দেশের মুক্তবুদ্ধির চর্চা,বাক-স্বাধিনতার চর্চা স্বীকৃত হয়।বই টি নিষিদ্ধের কারণ সম্পর্কে বলা হয়-
মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতি তথা মৌলিক বিশ্বাসের পরিপন্থি আপত্তিকর বক্তব্য...
ধর্ম কি তবে এতই ঠুনকো যে একটা বই এর আঘাত সহ্য করতে পারবেনা???

ধর্মানুভূতি ব্যাপারটা বেশ রহস্যময়।অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এই অনুভূতি কেবল মাত্র সংখ্য গুরুদের একক সম্পত্তি!সংখ্যালঘুদের এখানে কোন অধিকার নেই।তাদের কোন ধর্মানুভূতি নেই,তাই তাদের মন্দির ভাঙ্গলেও কিছু যায় আসেনা।কিন্তু বাইরের দেশে কোথাও মসজিদ ভাঙ্গার খবর শুনলে এখানে তান্ডব শুরু হয়ে যায়-এতই সংবেদনশীল এই অনুভূতি!কোন দেশে কেউ একজন মহানবি কে ব্যাংগ করে ছবি বানিয়েছে-তার প্রতিবাদে এখানে জঙ্গি মিছিল হয়!সাধু সাধু!তবে ইসলামি দৃষ্টিতে এই মন্দিরের মূর্তি ভাঙা ধার্মিকরাই কিন্তু প্রকৃত ধার্মিক।হযরত ইব্রাহিম মূর্তি ভেঙ্গেছিলেন,হযরত মুহম্মদ (স) কাবা ঘরের মূর্তি ধ্বংস করেছিলেন।কাজেই যারা "রাষ্ট্রধর্ম ইসলামের" এর দেশে মূর্তি ভাঙ্গে তারা মূলত তাদের সুন্নতি দায়িত্ব পালন করে।আর যারা বলে "ইহা প্রকৃত ইসলাম নহে" তারাই ভন্ড!কাজেই সমস্যা টা কোথায় এটা বুঝা কঠিন কিছু না!
তাই যারা এই যৌক্তিক প্রশ্ন গুলো তোলে তাদের উপর নেমে আসে খড়গ।হুমায়ুন আজাদের নারী বই নিষিদ্ধ করে কোন লাভ হয়নি বরং তা স্বাভাবিক নিয়মেই দ্বিগুন শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে।তাই হয়তো ধর্মরক্ষাকারীরা হুমায়ুন আজাদের বই কে নয়,হুমায়ুন আজাদ কেই পৃথীবি থেকে নিষিদ্ধ করে দিতে চেয়েছে!তবে এখানেও তারা ব্যর্থ।হুমায়ুন আজাদ আরও কয়েকশ গুন বেশি শক্তি নিয়ে এখন বিচরন করছেন!তাকে ওরা না মারলে হয়তো তিনি বেচে থাকতেন কিন্তু এখন তিনি হয়েছেন 'অমর'।
তসলিমা নাসরিনের "লজ্জা" নিষিদ্ধ করা হয় ১৯৯৩ সালে। অভিযোগ তোলা হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে উসকে দিয়েছে এ বই। মৌলবাদীরা তসলিমাকে দেশ ত্যাগেও বাধ্য করে। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হলেও বিশ্বের অনেক ভাষায় ‘লজ্জা’ বইটি অনূদিত হয়েছে। পরবর্তীকালেও তসলিমার আত্মজীবনী ‘আমার মেয়েবেলা, ‘উত্তল হাওয়া’, ‘ক’, ‘সেই সব অন্ধকার’ নিষিদ্ধ করা হয়। তসলিমা নারীবাদিতার সামনে এসে দাঁড়ায় রাষ্ট্র, ধর্ম, সমাজ, পুরুষতন্ত্র। তার আত্মজীবনী তৃতীয় খণ্ড ‘দ্বিখণ্ডিত’ পশ্চিমবঙ্গে ১ বছর ৯ মাস ২৬ দিন বন্দি থাকার পর হাইকোর্টের রায়ে মুক্তি পায়। সেখানে সচেতন লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা তার বইয়ের পাশে, লেখকেরা মত প্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন।

আসলে যারা তসলিমা নাসরিনের বই নিষিদ্ধ করেছে,তাকে দেশ ছাড়া করেছে তাদের তসলিমার বক্তব্যের জবাব দেয়ার যোগ্যতাটুকু নেই।তাঁর যুক্তি খন্ডন করে পালটা যুক্তি সৃষ্টির ক্ষমতাটুকু নেই।কারণ প্রশ্ন করতে আমরা ভয় পাই।প্রশ্ন করাই এ মুল্লুকে নিষিদ্ধ!

তবে সত্যের স্বাভাবিক ধর্মই হল প্রকাশিত হওয়া যেমন আলোর স্বাভাবিক ধর্ম অন্ধকার হটানো।বই নিষিদ্ধ করে মূলত সেগুলোর আবেদন,সেগুলোর প্রতি আগ্রহই বাড়িয়ে তোলা হয় যেটা নির্বোধরা,যারা বই নিষিদ্ধ করে তারা কোনদিন বুঝবে না।আমাদের বিশ্বাসের শিকড় এত গভীরে প্রোথিত যে আপনি যতই ভাল মানুষ হোন না কেন,যতই সৎ গুণে গুনান্বিত হন না কেন,সেই বিশ্বাস গুলোকে লালন না করলে,সেগুলোকে প্রশ্ন করলে মানুষ আপনাকে ঘৃণা করবে।আপন জনেরা দূরে সড়ে যাবে।সামাজিক ভাবে হবেন এক ঘরে!তবে এটাও সঠিক এক যুগের নিষিদ্ধ পরবর্তি যুগের আলোর সূচনা করে।
সক্রেটিস কে সত্য বলার জন্য হেমলক পান করতে হয়েছিল।তোমার ঠোটের সামনে এখনও তো বিষের পেয়ালা তুলে ধরা হয়নি...তুমি কথা বল...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন