Powered By Blogger

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়-আশা ও বাস্তবতা

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখেনা এমন ছেলে মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাবেনা।ছোট বেলা থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের কল্পনায় নিমজ্জিত ছেলে মেয়েরা জিবনের নানা বাক পেরিয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের দোড়গোড়ায় এসে পৌছে তখন সবার সুযোগ ঘটেনা সেই দরজা অতিক্রম করার।

অল্প কিছু ভাগ্যবান সেই সুযোগ নিয়ে এই স্বপ্নের জগতে পা রাখে।

বহুদিনের মোহ ভাঙতে দেরি হয়না।হলে সিট না পেয়ে গণ রূমে মশা আর ছার পোকার কামড় খেয়ে আর হলে না থাকা শিক্ষার্থীরা ভার্সিটির বাস গুলোতে বাদর ঝোলা হয়ে প্রতিদিন ক্লাস করে টিকে থাকে।

কিন্তু তারপর ও একটা অনেক বড় মানসিক তৃপ্তি নিয়ে দিন কাটায় এই ছেলে মেয়ে গুলো-দেশের সব থেকে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হয়ে।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে নানা রকম সমস্যা।আমরা ভেবে দেখেছি কি এই সমস্যা গুলো কেন?সমাধান হচ্ছেনা কেন?



বেশ কয়েক বছর ধরে "বিশ্ববিদ্যালয় রেটিং" বলে একটা কথা আমাদের সামনে আমরা দেখছি।আমি বিষয় টি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি।পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে একই মান দন্ডের ভিত্তিতে বিচার করা কতটা যুক্তি যুক্ত সেটা ভাবার বিষয়।

বিশ্ববিদ্যালয় কি?বিদ্যালয় আর বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে পার্থক্য কি?এখানে কি শিক্ষার্থীরা কেবল পাঠ্যবই অধ্যয়ন করতেই আসে?এ প্রশ্ন গুলো খুব জরুরী কারণ সব সম্ভবের দেশে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংজ্ঞা বদলে দিয়েছি।



বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু জ্ঞান দান করা হবেনা নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করা হবে,জ্ঞানের সংমিশ্রণ ঘটবে,শিক্ষার্থীরা শারীরিক ও মানসিক ভাবে জ্ঞান নির্ভর সমাজ বিনির্মাণের প্রকৃত যোদ্ধা হবে।পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্র-সমাজ পরিচালনায় সহায়ক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে।অথচ আমাদের দেশে এমন অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে যেখানে মৌলিক বিষয় গুলোই পড়ানো হয়না।যেমন কটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন পড়ানো হয়??

সত্যি কথা হচ্ছে মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানি গুলোতে কম বেতনের শ্রমিক বানানোর প্রত্যয় নিয়ে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর জন্ম ।

অর্থাৎ পড়াশুনা এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে চাকরি অর্জনের উপায়।লক্ষ ও উদ্দেশ্য যাদের চাকরি ও সার্টিফিকেট প্রদান।এসব ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেটিং হাস্যকর বিষয় অথচ কি আশ্চর্য!মনস্তাত্বিক ভাবে এই রেটিং তরুন প্রজন্মের কাছে গ্রহন যোগ্য।



প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সমস্যা গুলোর কথা বললাম,সেগুলোর সমাধান কি নেই?সমাধান আছে কিন্তু হবেনা,কারন সমস্যা গুলো ইচ্ছাকৃত ভাবে সৃষ্টি করা।

বৃটিশ আমলে এদেশিয় তথা ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষরা শিক্ষা পেত।কিন্তু বৃটিশ রা ততটুকু শিক্ষা আমাদের জন্য উন্মুক্ত করে রেখেছিল যেটা দিয়ে তাদের জন্য শিক্ষিত দাস তৈরি করা সম্ভব।যে শিক্ষার সাহায্যে আমরা বৃটিশ দের সমকক্ষ হতে পারি সেই শিক্ষা কিন্তু তারা আমাদের জন্য বন্ধ করে রেখেছিল।

এটা বলছি কারন এখন কার অবস্থাও অনেক টা একই রকম।



পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলো হল মুক্ত বুদ্ধি ও সংস্কৃতির চর্চা কেন্দ্র,যা কিনা সত্যিকারের মানুষ তৈরি করে,প্রতিবাদী চেতনার জন্ম দেয়।এই চেতনা লুটেরা,শোষক তথা মৌলবাদিদের কাছে হুমকি স্বরূপ।পশ্চিমা দেশ গুলোও আমাদের থেকে শিক্ষিত দাস চায়,যার ফলে দেখা যায় তারা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে টাকা খাটায়,সেখানকার ছাত্র দের "লোভনীয় বেতনের কাজ"-এর ব্যবস্থা করে দেয়।ব্যবসা করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর "মালিক"রা,সাধারন ছাত্র-ছাত্রীরা হয় প্রতারিত যা তারা বুঝতেও পারেনা।প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে রাজনীতি কিংবা দল গঠন নিষিদ্ধ এ জন্যই।আজ পাবলিক কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কতৃপক্ষ কোন অন্যায় সিদ্ধান্ত অথবা কাজ করলে সাথে সাথে ছাত্ররা রাস্তায় নামবে আর সেটা কে প্রতিরোধ ও করবে,কিন্তু প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে??উল্টো সেখান কার ছাত্র দের এটা বুঝানো হয় যে রাজনীতি খারাপ,এতে পরিবেশ নষ্ট হয় ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলো কখনই ছাত্র-রাজনীতি করতে দিবেনা কারণ তাতে ছাত্রদের বাধায় তারা নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে পারবেনা।



একই কাজ এই পশ্চিমা মদদ পুষ্ট ব্যবসায়ি শ্রেনী করতে চাচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে।

বলা হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলতে গবেষণা হয় না।আমার জানামতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গবেষক কে ৬০০০ টাকা গবেষণা বাবদ দেয়া হয়।এ বরাদ্দ দেয়া শুরু হয়েছিল ১৯৬৯-৭২ সালের মধ্যে।তখনকার ৬০০০ টাকা কি এখনকার ৬০০০ হাজার সমান??তাহলে আমরা উন্নত গবেষনা কি করে আশা করব?



৬০ এর দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত ১২০০০-১৫০০০ ছাত্র-ছাত্রী,হল ছিল ৮ টি।বর্তমানে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৪০,০০০ এর কাছাকাছি কিন্তু হল ১৭ টি।বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রী সংখ্যা মোট শিক্ষার্থীর ৪৫% কিন্তু হল মাত্র ৪ টি।৪ জন থাকতে পারে এমন রূমে থাকে প্রায় ২০ জন।তবে ব্যবসার জন্য আর দখল বাজির জন্য এ ধরণের সমস্যা খুব ভাল,কিভাবে?বলছি...

যেহেতু সিট পাওয়া যায় না,পেলেও থাকা না থাকা নির্ভর করে হল নিয়ন্ত্রণকারি 'বড় ভাই' দের উপরে,সুতরাং থাকে মেসে কিংবা বাসা ভাড়া করে,চলে বাণিজ্য।হলে থাকা আর না থাকার ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিভাজন তৈরি হয়।যারা হলে থাকে তাদের জীবন যাত্রা এক রকম,যারা বাইরে থাকে তাদের অন্য রকম।



যারা বাইরে থাকে তাদের একটা বড় অংশ তো বিশ্ববিদ্যালয় কে প্রায় "স্কুল" বলে মনে করে।সকালে ক্লাসে আসে আর ক্লাস শেষে কোন দিকে না তাকিয়ে সোজা বাসায় চলে যায়।এখানে ক্লাস ছাড়াও যে একটা সাংস্কৃতিক পরিমন্ডল আছে সেটা না জেনেই তারা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করে।



বেতন বাড়ালে শিক্ষার্থীরা ক্ষেপে যাবে তাই কৌশলে অন্য ভাবে টাকা আদায় করা হয়।যেখানে মাসিক বেতন ২০ টাকা সেখানে একটা প্রত্যয়ন পত্র নিতে গেলে ১২০ টাকা দিতে হয়।উন্নয়ন ফি এর নামে যে টাকা নেয়া হয় সেটা কোথায় কিভাবে ব্যয় হয় তার কোন স্বচ্ছতা নেই।



হল ক্যান্টিন ক্যাফেটেরিয়া গুলোতে কিভাবে খাওয়ানো হচ্ছে তা দেখার লোক নেই।ভাতে পাথর পেলে ছাত্র-ছাত্রীরা মনে করে ২০-২৫ টাকায় এর বেশি আর কি পাওয়া যাবে।কিন্তু তারা জানেনা তারা যে ২০ টাকার খাবার খায় তার পিছনে সাবসিডির পরিমাণটা নেহাতই কম নয়।



এসব সমস্যা সৃষ্টির উদ্দেশ্য হল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় গুলোকে ধীরে ধীরে পঙ্গু করে দেয়া।শিক্ষার জন্য পশ্চিমা নীতি অনুসরণ করা-যার টাকা আছে সে শিক্ষা পাবে যার নাই সে পাবেনা।এখনো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন অনেক ছেলে মেয়ে পড়তে আসে যাদের বেতন এর টাকাটা টিউশনি করে যোগাড় করতে হয়।



এসবের বিরূদ্ধে ছাত্র দের কেই রুখে দাড়াতে হবে।কিন্তু দুর্ভাগ্য ব্যবসায়ি শ্রেনী নানা অপপ্রচারের মাধ্যমে আমাদের মেরুদন্ড নরম করে দিয়েছে,তাই আমরা প্রতিবাদ করার সাহস টুকু অর্জন করতে পারিনা।এমনকি প্রতিবাদ যে করতে হবে সেটাও আমাদের চিন্তায় আসেনা।



আমরা কি জানি ২০২৬ সালের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কে নিজের খরচে চলতে হবে।তো তখন বিশ্ববিদ্যালয় টিকিয়ে রাখতে হলে অবধারিত ভাবে বেতন-ফি বাড়াতে হবে,এবং আমাদের খরচের পরিমাণ টা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর সম পরিমাণ হবে।কি খুশি লাগছে তত দিনে বের হয়ে যাবেন ভেবে?তাহলে আমার কিছু বলার নেই।

মাঝে মধ্যে মনে হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিসিএস পরিক্ষার কোচিং সেন্টার কারন এখান কার বেশির ভাগের লক্ষ্য বিসিএস দেয়া।সেটা সমস্যা না,সেটা স্বাভাবিক কিন্তু যখন এটাই একমাত্র লক্ষ হিসেবে বিবেচিত হয় তখন তা চিন্তার কারণ ই বটে।



এই লেখায় আমি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু কথা উল্লেখ করেছি,যা অনেকের হয়তো খারাপ লাগতে পারে কিন্তু কথা গুলো সত্য।এখন অনেক প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় এই নানা রকম গবেষণা মূলক কাজ হচ্ছে যা প্রশংসার দাবিদার কিন্তু মৌলিক সমস্যা গুলো রয়েই গেছে।



যতদিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি না বাড়বে,ততদিন দেশের উন্নতি হবেনা।যতদিন এক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব না দেয়া হবে ততদিন জ্ঞান সৃষ্টিও সম্ভবপর না।



তবে আমরা আশা রাখতে চাই...স্বপ্ন দেখতে চাই...

কারণ আমরাই তো বাংলাদেশ...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন